২১ নভেম্বর ২০২৫ এর ভূমিকম্প অনেককে অপ্রস্তুত অবস্থায় ধরেছে। কয়েক সেকেন্ডের কম্পন শেষ হলেও ভয়টা থেকে গেছে দেয়াল, কলাম আর স্ল্যাবে দেখা নতুন ফাটলে।
সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কেউ গ্যারেজে ঢুকে ফাটল দেখে থমকে দাঁড়িয়েছেন। কেউ বাসায় ফিরে সিলিংয়ের সরু দাগটা দেখে ভাবছেন, এখানে থাকা ঠিক হবে কি না। আশেপাশের সবাই একে অন্যকে ফোন করে ছবি পাঠিয়েছে, কেউই নিশ্চিত নয় কী করলে ঠিক হবে।
এই লেখার মূল ফোকাস একটাই। ক্র্যাকের ধরন দেখে আপনি অন্তত প্রথম সিদ্ধান্তটা নিজে নিতে পারবেন। কোন ফাটল নিয়ে পর্যবেক্ষণ করবেন, কোনটার জন্য ইঞ্জিনিয়ার ডাকবেন, আর কোনটার ক্ষেত্রে এখনই বাসা ছাড়বেন। ইঞ্জিনিয়ারের জায়গা নেওয়া না, শুধু আপনার নিজের বোঝাপড়া আর সিদ্ধান্ত নেয়া একটু সহজ করা।
এই লেখা শুধু প্রাথমিক গাইড। আপনার ভবন নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সব সময় লাইসেন্সধারী structural engineer-এর পরামর্শ অনুযায়ী নেবেন।
ভূমিকম্পের পর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন: আমার বাড়ি কি নিরাপদ
কম্পন থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথায় আসে দুইটা প্রশ্ন। আমি কি এখনই বাইরে চলে যাব। নাকি একটু দেখে, বুঝে, শান্তভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়।
সব ফাটল একই কথা বলে না। কিছু ফাটল কসমেটিক, পরে রিপেয়ার করলেই হয়। কিছু ফাটল আবার সরাসরি কাঠামোগত দুর্বলতা দেখিয়ে দেয়।
Hairline crack আর structural crack আসলে কী
Zone নিয়ে কথা বলার আগে দুটো জিনিস পরিষ্কার থাকা দরকার. Hairline crack আর structural crack এক জিনিস না।
Hairline crack কী
• Hairline crack বলতে খুব সরু ফাটল বোঝায়, সাধারণত প্রস্থ ১–২ মিমি এর কম।
• বেশির ভাগ সময় এগুলো শুধু প্লাস্টার, পেইন্ট বা রেন্ডার লেয়ারে থাকে, ইট বা কংক্রিট পর্যন্ত যায় না।
• শুকিয়ে যাওয়া, তাপমাত্রা ওঠানামা বা খুব হালকা বসে যাওয়া (settlement) থেকে এই ফাটল দেখা দেয়।
• এগুলো সাধারণত ভবনের স্থিতিশীলতার জন্য আলাদা করে বড় ঝুঁকি তৈরি করে না। তবে নজরে রাখা ভালো।
Structural crack কী
• Structural crack সাধারণত বেশি চওড়া, লম্বা, বা এমন প্যাটার্নে হয় যেটা দেখে বোঝা যায় ভেতরে আসল মুভমেন্ট হচ্ছে।
• উদাহরণ: জানালা–দরজার কোণ থেকে তির্যক ফাটল, ইটের গাঁথুনিতে সিঁড়ির মতো স্টেপ ফাটল, বা দেয়াল জুড়ে লম্বা আনুভূমিক ফাটল।
• এই ধরনের ফাটল অনেক সময় foundation বসে যাওয়া, subsidence, বা দেয়ালে বেশি পাশের চাপের (lateral pressure) সাথে সম্পর্কিত থাকে।
• এগুলোকে সব সময় সিরিয়াসলি নিতে হবে. বেশির ভাগ সময় Orange Zone বা Red Zone ক্যাটাগরির মধ্যে পড়ে।

Image 1 – Types of crack in building
বোঝার সুবিধার জন্য আমরা তিনটা Zone ধরে এগোবো। Green Zone, Orange Zone, Red Zone।
Green Zone – ছোট ফাটল, বড় আতঙ্কের দরকার নেই
এগুলো সেই ফাটল, যেগুলো দেখে প্রথমে একটু ঘাবড়ে ওঠা স্বাভাবিক, কিন্তু একটু দেখে বুঝলে বোঝা যায় এগুলো মূল কাঠামোর জন্য বড় ঝুঁকি না।
দেখতে কেমন (What it looks like)
• সাদা বা রঙ করা প্লাস্টারে সরু hairline ফাটল
• প্রস্থ প্রায় ১–৩ মিমি
• ইট বা কংক্রিট পর্যন্ত গভীর যায় না, উপরিভাগেই থাকে
উদাহরণ (Examples)
• ড্রইংরুমের সিলিংয়ে সরু একটানা ফাটল, হাত বুলিয়ে সামান্য গর্তের মতো লাগে
• boundary wall এর প্লাস্টারে উপরের দিকে কয়েকটা সূক্ষ্ম দাগ, দেয়াল সোজা দাঁড়ানো, কোনো অংশ বেঁকে যায়নি

Image 2 : Green Zone example –সাদা প্লাস্টার দেয়ালে ছোট ও স্থির hairline crack, যা প্লাস্টার আর রঙের স্তরে সীমাবদ্ধ Green Zone-এর কসমেটিক ফাটল।
এগুলো সাধারণত প্লাস্টার শুকানোর সময় সঙ্কোচন, তাপমাত্রা পরিবর্তন, বা পুরোনো পেইন্টের ফাটাধরা থেকে হয়। ভূমিকম্প এসব ফাটলকে একটু স্পষ্ট করে তুলতে পারে। এতে আতঙ্কের দরকার নেই, কিন্তু নজরে রাখাটা দরকার।
আপনি কী করবেন (What to do)
• ফাটলের শুরু আর শেষ প্রান্তে পেন্সিল দিয়ে ছোট দাগ দিন
• পাশে আজকের তারিখ লিখুন
• সপ্তাহে একদিন একই অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুলুন
• দুই–তিন সপ্তাহে প্রস্থ বা লম্বা না বাড়লে পরে রিপেয়ারের সময় flexible filler, নতুন প্লাস্টার আর পেইন্ট দিয়ে সমাধান করুন
এখানে মূল বিষয়টা মানসিক শান্তি। আপনি জানেন ফাটল আছে, মেপে রেখেছেন, নজরে রাখছেন। এটা আপনাকে নিয়ন্ত্রণ দেয়, অকারণ ভয় কমায়।
Orange Zone – সাবধান হওয়ার সিগনাল
এগুলো সেই ফাটল, যেগুলো দেখলে আপনি বাসা ছেড়ে তৎক্ষণাৎ পালিয়ে যাবেন না। কিন্তু দেরি না করে পেশাদার সাহায্য নেবেন।
দেখতে কেমন (What it looks like)
• জানালা বা দরজার কোণ থেকে ৪৫ ডিগ্রি কোণে তির্যক ফাটল
• ইটের গাঁথুনিতে সিঁড়ির ধাপের মতো প্যাটার্ন
• প্রস্থ সাধারণত ৩–৫ মিমি
• কয়েক দিন পর পর একটু করে বাড়ছে
উদাহরণ (Examples)
• শোবর ঘরের উইন্ডোর ডান কোণ থেকে তির্যক ফাটল নেমে এসে মাঝ দেয়ালে থেমে গেছে
• গ্যারেজের ইটের দেয়ালে প্রতি দুই–তিনটি ইট পর পর ভাঙা ভাঙা ফাটল, নিচের দিকে একটু বেশি চওড়া

Image 3 : Orange Zone example – জানালার কোণ থেকে তির্যক ফাটল এবং ইটের গাঁথুনিতে সিঁড়ির মতো crack pattern, যা ভিত্তি একটু সরে যাওয়া এবং Orange Zone-এর সতর্কতা ঝুঁকি দেখায়।
এগুলো অনেক সময় দেখায় ভিত্তির এক অংশ অন্য অংশের তুলনায় বেশি বসে যাচ্ছে। দেয়ালের ওপর পাশের চাপ বেড়ে যায়, shear তৈরি হয়। এই পর্যায়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নিলে অনেক বড় সমস্যা আগেই থামানো যায়।
বিশেষ করে parapet wall এ ফাটল বা ছোট গর্ত থাকলে সময়মতো রিপেয়ার করা খুব জরুরি। না হলে ইট বা প্লাস্টার ভেঙে নিচে পড়ে হঠাৎ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, বিশেষ করে গাড়ি চলাচল বা মানুষের চলাফেরার ওপর দিয়ে।
আপনি কী করবেন (What to do)
• রুলার দিয়ে ফাটলের প্রস্থ লিখে রাখুন, তারিখসহ
• তিন দিন পর পর একই জায়গায় মাপ নিন, একই দিক থেকে ছবি তুলুন
• দেখুন ফাটল কি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে, নাকি একসময় থেমে গেছে
• এক সপ্তাহের মধ্যে RAJUK অনুমোদিত বা IEB রেজিস্টার্ড স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার সাইটে ডাকুন
• ইঞ্জিনিয়ার আসার আগে ফাটলওয়ালা দেয়ালের পাশে ভারী আলমারি, ফাইল ক্যাবিনেট বা পানির ট্যাংক থাকলে সরিয়ে নিন
• parapet বা exposed দেয়ালে গর্ত থাকলে অস্থায়ীভাবে হলেও সেগুলো বন্ধ করুন, যাতে ইট বা প্লাস্টার নিচে না পড়ে
এখানে আপনার লক্ষ্য আতঙ্ক নয়, প্রস্তুতি। আপনি তথ্য সংগ্রহ করছেন, ডেটা দিচ্ছেন, আর একটি পেশাদার মতামতের জন্য মাঠ পরিষ্কার রাখছেন।
“দেয়ালে ফাটল দেখলে ভয় না পেয়ে, প্রথম কাজ হওয়া উচিত নিরাপত্তা যাচাই করা। ঘর পরে ঠিক করা যাবে, আপনাদের আগে নিরাপদ থাকা দরকার।”
KAZI MOHAMMAD ALAM KAISER
Architect, Studio Archifiction
Red Zone – আগে মানুষ, পরে ভবন
এগুলো সেই ফাটল, যেগুলো দেখলে সিদ্ধান্ত একটাই। আগে সবাইকে নিরাপদে সরিয়ে নিন, তারপর ভাবুন ভবনের কী করা যায়।
দেখতে কেমন (What it looks like)
• কংক্রিট স্ল্যাবে বড় আনুভূমিক ফাটল, সেকশন যেন ভেঙে আলাদা হয়ে গেছে
• কলামে মোটা vertical বা diagonal ফাটল, plaster উঠে ভিতরের aggregate বা steel bar দেখা যাচ্ছে
• beam-column joint এ মোটা ফাটল, আশপাশের concrete চিপ হয়ে পড়ছে
• প্রস্থ ৫ মিমি বা তার বেশি, এক জায়গায় না, নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে

Image 4 : Red Zone example – কলাম ও স্ল্যাবে গভীর আনুভূমিক এবং vertical crack, যেখানে কংক্রিট ভেঙে steel পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, যা কাঠামোগত ব্যর্থতার উচ্চ ঝুঁকির Red Zone-এর সিগনাল।]
উদাহরণ (Examples)
• সিঁড়িঘরের কলামে এমন ফাটল, যেখানে হাত দিয়ে touch করলে concrete crumbly লাগে
• বেজমেন্ট বা রিটেইনিং ওয়ালে লম্বা আনুভূমিক ফাটল, বর্ষার সময় পানি ঢুকে দেয়াল ভিজে থাকে, পেছন থেকে চাপ অনুভূত হয়
এগুলো কাঠামোগত ক্ষতির সোজাসুজি সিগনাল। এই পর্যায়ে ঝুঁকি নেয়ার মানে নিজের এবং পরিবারের জীবনকে বাজি ধরা।
আপনি কী করবেন (What to do)
• লিফট ব্যবহার না করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামুন
• ভবন থেকে যত দূরে সম্ভব খোলা জায়গায় দাঁড়ান, যেখানে গাড়ি বা অন্য ভবন পড়ে আসার ঝুঁকি কম
• ৯৯৯ নম্বরে কল করে ফায়ার সার্ভিস ও ডিফেন্সকে জানান
• পরে অনুমোদিত স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে detailed assessment করান এবং RAJUK নির্দেশনা মেনে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিন
RAJUK কীভাবে বিল্ডিং কোড আর ভূমিকম্প নিরাপত্তা নিয়ম প্রয়োগ করে, সেটা বুঝতে চাইলে BNBC 2020 ভিত্তিক অফিসিয়াল সারাংশ ডকুমেন্ট একবার দেখে নিতে পারেন।
এখানে “আমি একটু দেখে আসি” টাইপ কৌতূহলও ঝুঁকিপূর্ণ। কেউ যদি ফাটলওয়ালা অংশে যেতে চায়, তাকে থামান।
ভূমিকম্পের পর আপনার ছোট To Do List
| রং | ফাটলের ধরন | বৈশিষ্ট্য | করণীয় |
|---|---|---|---|
| সবুজ (নিরাপদ) | Hairline crack, প্লাস্টার/পেইন্টের সূক্ষ্ম সোজা ফাটল | প্রস্থ প্রায় ১–৩ মিমি, শুধু প্লাস্টার/রঙে, কয়েক সপ্তাহেও বাড়ছে না | নজরে রাখুন, ছবি ও তারিখ লিখে রাখুন, পরে নিজেরাই ফিলার/প্লাস্টার দিয়ে মেরামত করুন |
| কমলা (সতর্কতা) | তির্যক crack, সিঁড়ির মত crack, ক্রমবর্ধমান ফাটল | প্রস্থ প্রায় ৩–৫ মিমি, জানালা–দরজার কোণ বা ইটের গাঁথুনিতে, কয়েক দিনে একটু একটু বাড়ছে | রুলার দিয়ে মাপুন, ছবি তুলুন, ৭ দিনের মধ্যে RAJUK অনুমোদিত বা IEB রেজিস্টার্ড structural engineer ডাকুন |
| লাল (বিপদ) | আনুভূমিক ফাটল, কলাম বা beam–column joint ফাটল, ৫+ মিমি প্রশস্ত ফাটল | কংক্রিট/গাঁথুনির ভেতর দিয়ে গভীর, দ্রুত ছড়াচ্ছে, পানি বা আলো ভিতর দেখা যায় | এখনই ভবন ছাড়ুন, ৯৯৯ এ কল করুন, তাত্ক্ষণিক structural engineer ও RAJUK-এর নির্দেশনা নিন |
Chart 1 : To Do List – Dhaka Earthquake 2025 এর পর Green Zone, Orange Zone, Red Zone তিন শ্রেণি আর প্রতিটি ধাপের দ্রুত করণীয় দেখানো সংক্ষিপ্ত To Do List চার্ট।
দিনের শেষে আপনার ফোকাস তিনটে জিনিসে থাকুক। মানুষ। গ্যাস–বিদ্যুৎ। ফাটল।
সবাই ঠিক আছে কি না দেখুন, ছোট আঘাত হলেও সিরিয়াসলি নিন
গ্যাস লাইন, চুলা, সিলিন্ডার, ইলেকট্রিক মেইন সুইচ পরীক্ষা করে সন্দেহ থাকলে বন্ধ রাখুন
Green Zone, Orange Zone, Red Zone তিন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে আপনার পুরো ফ্ল্যাট, সিড়িঘর, গ্যারেজ, বেজমেন্ট, boundary wall আর parapet একবার ঘুরে দেখুন
ছবি, ভিডিও, মাপ আর তারিখ লিখে রাখুন, যেন পরের বার ইঞ্জিনিয়ারকে পরিষ্কারভাবে বোঝাতে পারেন
যদি এই সব দেখে এখনও সিদ্ধান্তে আসতে কষ্ট হয়, আগে লাইসেন্সধারী স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারকে দেখান। পরে প্রয়োজনে আপনার নিজের ডিজাইন টিম বা Studio Archifiction-এর মতো কনসালট্যান্টের সঙ্গে বসে রিপেয়ার আর ভবিষ্যতের শক্তিশালীকরণ প্ল্যান করা যায়, যাতে একই ভবনে নিরাপদভাবে থাকা যায়।
শেষে একটা কথা। দেয়ালের ফাটল মানেই সব শেষ, এমন না। আবার “কিছুই হবে না” ভেবে সব ফাটল এড়িয়েও যাওয়া ঠিক না। আপনি যদি এই তিনটা Zone-এর লজিক ধরে শান্তভাবে সিদ্ধান্ত নেন, আর প্রয়োজন হলে ইঞ্জিনিয়ারের সাহায্য নেন, তাহলে নিজের পরিবার আর ভবনের জন্য সবচেয়ে দায়িত্বশীল কাজটাই করবেন।